ওমর ফারুক নাঈম::
বাসায় ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ-ই ফেইসবুকে আসলো একটি ভিডিও। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনাটি ফেইসবুকে লাইভ করেছে অলিউর রহমান নামের একটি তরুণ। তার ভিডিওটি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। অনেক মানুষের জীবণ শেষ করে দিচ্ছে। ভিডিওটির ৪০ মিনিটের পর দেখলাম হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণ। প্রচন্ড আওয়াজে কেঁপে উঠছে সবকিছু। এরপর থেকে ভিডিওটিতে শুধু অন্ধকার অন্ধকার। এক পর্যায়ে লাইভটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভিডিওটির নিচের কমেন্ট বক্সে অনেকে কমেন্ট করেছে, যে লাইভ করেছে তার এখন কি অবস্থা? সে কি বেঁচে আছে।
অলিউর রহমান নামের আইডিতে গেলাম। দেখলাম তার আইডিতে হোম ডিস্ট্রিক্ট দেয়া মৌলভীবাজার। ভাবলাম খোঁজ নেয়া দরকার। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তাকে কভারেজ করা আমার দায়িত্ব হয়ে গেলো। তার ফেন্ড লিস্টে ডুকে খোঁজ ছিলাম, আমার পরিচিত কেউ আছেন কি না। এরই মধ্যে বিভ্রান্তিতে পরে যাই। কারণ বদরুল নামের একজন ইতিমধ্যে কমেন্টে করে বলে দিয়েছেন। সে বেঁচে আছে। আমি নিজেই অনুসন্ধনে নেমে যাই, খোঁজ করতে করতে পেয়ে যাই। অলিউর রহমানের কাছের বন্ধু মাহিমকে। তাকে ম্যাসেইজ দেই। কিন্তু গভীর রাত থাকায় সে গুমিয়ে ছিলো। সে সমাজকর্মী যার কারণে ফেইসবুক ওয়ালে তার ফোন নাম্বারটি দেয়া ছিলো। গভীর রাতেই তাকে কল দিলাম। প্রথমবার কল রিসিভ করে নি। আধা ঘন্টার পর আবারো কল দিলাম। এবার রিসিভ করলো। তার সাথে কথা বললাম, তার বক্তব্য সে এখনো নিশ্চিত নয় যে অলিউর কোন অবস্থায় আছে। তবে শুনেছে বেঁচে আছে। তবে শতভাগ নিশ্চিত নয়। তার কাছ থেকে আনলাম। যে মাঝির মাধ্যমে ডিপোতে চাকুরীতে গিয়েছিলো অলিউর তার মোবাইল নাম্বরটি। তার সাথে কথা বললাম, তিনিও কিছু তথ্য দিতে পারলেন না। এরপর মাহিমকে বললাম, বদরুল ইসলামের নাম্বরটি দিতে, যিনি দাবী করেছেন অলিউর বেঁচে আছে।
মধ্য রাতে গভীর ঘুমে ছিলেন বদরুল ইসলাম। তাকে কল দিলাম, তিনি কথা বলে জানালেন, তিনিও নিশ্চিত না যে অলিউর বেঁচে আছে। তার কাছ থেকে আনলাম রুয়েল নামে অলিউরের সহকর্মীর নাম্বার। রুয়েলকে রাতেই কল দিলাম, সে জানালো। তারা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন, অলিউরের কোন খোঁজ নেই। অলিউর তার সাথে থাকেন। তিনি বের হওয়ার সময় অলিউরকে বলেছেন আসতে কিন্তু। সে আসেনি। লাইভ করার জন্য সেখানেই থেকে যায়। তার সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন প্রচন্ড শব্দে একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছিলো। তথ্য নিয়ে অফিসে রাত ৪:১২ মিনিটে পাঠলাম, “
বিস্ফোরণকে লাইভে ধারণ করা অলিউর নিখোঁজ”। সকালে ঢাকা পোস্টের লিডে আসলো এটি। ফজরের নামাজটা পড়ে ঘুমালাম। উঠেই দেখি অসংখ্য সহকর্মীর ফোন। সারাদেশে অনেক হিট করেছে নিউজটি। প্রচুর শেয়ার হচ্ছে। বিভিন্ন হাউজ থেকে তাদের প্রতিনিধিদের এস্যাইমেন্ট দিচ্ছে।
বেলা ১০টার দিকে আবার অলিউরের সহকর্মী রুয়েলকে কল দিলাম। তিনি জানালেন, অলিউর মারা গেছে। তার ক্ষতবিক্ষত লাশ চট্রগ্রাম মেডিকেলে পরে আছে। তারা এখনই রওনা দিচ্ছেন চট্রগ্রামের দিকে। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ঠিক সাড়ে ১১টায় অফিসে পাঠালাম “
লাইভ করা অলিউরের ক্ষতবিক্ষত লাশ আসলো হাসপাতালে”। খুব হিট হয়েছে এই নিউজটিও।
সন্ধ্যায় অফিসে বসে। অলিউরের পরিবার ও তার বন্ধু মাহিমের সাথে কথা বলছিলাম। একটি ফলোআপ রিপোর্ট তৈরীর জন্য। যখন অলিউর রহমানের স্বজনদের কথাশুনছিলাম, আর ভাবছিলাম ছেলেটার জীবন এভাবেই ঝরে গেলো। এখন তার পরিবারটিকে কে দেখবে। যে পরিবারের জন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে আয়রোজগার করার জন্য চাকুরীতে গিয়েছিলো, সেখানেই তার মৃত্যু হলো। তার আপন মা নেই। অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই বোনদের মায়ায় সে জীবন সংগ্রামে নেমেছিলো। এখন তার জীবনটাই স্থবির হয়ে গেল। কম্পিউটারে তখন আমার কি-বোর্ডটি চলছিলো না। হাত কাঁপছিলো। চোখে পানি চলে আসছিলো। রিপোর্ট লিখতে বসে কান্না চলে আসে। রাত ১১:৪৮ মিনিটে অফিসে পাঠালাম “
সংসার চালাতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ডিপোতে চাকুরি ধরে অলিউর”।
সোমবার (৬ জুন) সকালে অলিউরের লাশ আসলো বাড়িতে। দুপুরে জানাযার নামাজ হলো। কবর দেয়া হলো। বিশ বছর বয়সী জীবন সংগ্রামের এক যুদ্ধার অবসান এখানেই। পারি জমালেন পরকালে। সেখানে ভালো থাকিস অলিউর।
প্রতিবেদন:
এসংক্রান্ত আরো কিছু প্রতিবেদন:
ভিডিও:
0 Comments